প্রকৃতি সুনিপুণ গৃহিনীপনায় দক্ষিণ ২৪ পরগনা লাগোয়া হুগলী নদীর শেষ প্রান্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বদ্বীপ অঞ্চল গড়ে তুলেছে। ছোট আকারের দ্বীপগুলি হ্রস্ব দীর্ঘ নদ-নদী, খাল – খাড়ি দ্বারা পরিবেষ্টিত।সুন্দরী, গরান, গেঁয়র প্রবল উপস্থিতি আর গোলপাতার ঝোপে লালকাঁকড়ার হটাৎ লুকিয়ে পড়ায় মধ্যে কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। জল আর মাটির যুগলবন্দী থেকে উঠে আসা সোঁদাগন্ধ আর লবনাক্ত বাতাসের অবিরাম ঝাপটে চলা নবাগত নাগরিক শরীরকে দিশেহারা করে তুলতে পারে।নাতি দীর্ঘ উচ্চতার অরণ্যের ঘন হয় ওঠা অন্ধকার কেমন যেন রহস্যময়তা আর ছমছমানো ভয়ের উদ্রেক আনে।জনজীবনের প্রবাহধারায় প্রাণবন্ত স্বকীয়তা ও সৃষ্টির উন্মাদনায় আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে অগ্রগতি তা এখানে স্তিমিত। সেই চালচিত্রে আজ মৃত্যুর প্রহর গুনছে প্রায় গঙ্গাসাগরে বিপরীতে গড়ে ওঠা ঘোড়ামারা দ্বীপ ও তার জনজীবন। বিশ্ব উষ্ণায়নের আগ্রাসী ক্ষুধা দীর্ঘদিন ধরেই গিলছে দ্বীপে গড়ে ওঠা বসত ভূমিকে। ‘দ্যা টেম্পেস্ট’ নাটকের বৃদ্ধ প্রসপেরোকে মনে আছে, যার যাদুতে সমুদ্রের বুকে বিশাল বিশাল ঝড় তুলতো।যদিও তা ভৃত্য এরিয়ালের সাহায্য নিয়ে। আর সেই ঝড়ের তান্ডবের বাস্তব রূপ এখানকার দ্বীপের মানুষজনের নিত্যদিনের সঙ্গী কখনো আয়লা , কখনো বুলবুল, ইয়াস নামে। শিয়ালদা থেকে নামখানা লোকাল কিংবা ধর্মতলা থাকে বাসে করে চাইলে আসতে পারেন সুন্দরবনের হুগলীর মোহনায় নিভু নিভু ভগ্নপ্রায় এমনই দ্বীপের সন্ধানে।সন্ধান শব্দটি ব্যবহার করলাম এই কারণেই, সজাগ না থাকলে চোখ এড়িয়ে যেতে পারে এই অবহেলিত ভূখণ্ডটি। মহানগর থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। । কাকদ্বীপ বা নতুন রাস্তায় নেমে চলে আসুন লট নং ৮ এ। ওখানে মুড়িগঙ্গা নদী পেরনোর সময় ভ্রমণ বিলাসী চোখে দৃশ্যগোচর হবে নদীবক্ষে ভাসমান কুয়াশারদাম, যা স্থির হয়ে আছে নদীর স্রোতের বিরুদ্ধে। কিছুটা গেলেই বোঝা যাবে আজন্ম পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে লালন করা দ্বীপ ঘোড়ামারা। এখানে এলেই টের পাবেন নদী যেমন নর্তকীও হয়, তেমনই ধ্বংসীও; দশ আঙুলে ছিঁড়ে খাচ্ছে তিল তিল করে গড়েওঠা অসহায় প্রান্তিক মানুষদের বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলোকে। নদী পারাপারের সময় যদি দেখা মেলে দুলাল দাস কিংবা সুধীর মন্ডলের সাথে, নৌকায় বসে একগাল হেসে বলবে – ‘কি কইব কত বাপু, এই যে যশ (ইয়াস) গেলনি গঙ্গাবুড়ি সব গিলিয়ালিছে, কিচ্ছ নাই। পানের বরজ, পুকুরের মাছ ব্যাগগা ভাসিলিয়া পালিছে।’
IPCC রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৬ থেকে২০১৫ সালে সমুদ্রে জলস্তর প্রতি বছর 0.14 ইঞ্চি (3.6 মিলিমিটার) বেড়েছে, যা বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময় জুড়ে প্রতি বছর 0.06 ইঞ্চি (1.4 মিলিমিটার) গড় হারের 2.5 গুণ ছিল। এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ, বার্ষিক গড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে এক ফুট (0.3 মিটার) বাড়তে পারে, রক্ষা পাওয়া তখনই সম্ভব যদি গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন আসন্ন দশকগুলিতে আপেক্ষিক কম হয়। বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না নগরউন্নয়ন প্রকৃতিকে কি ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্তে । সেখানে দুলাল দাস কিংবা সুধীর মন্ডলের মতো মানুষজন চোখ ধাঁধানো সভ্যতার কাছে মূল্যহীন। সুইডেনের অধিবাসী গ্রেটা থুনবার্গ ২০১৮ সালে যে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানের কথা বলে ছিলেন তাকে আশু গুরুত্ব না দিলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
ঘোড়ামারা দ্বীপটির ভৌগোলিক অবস্থান 21°55′06′ উত্তর অক্ষাংশে এবং 88°07’30″ পূর্ব দ্রাঘিমায়। দ্বীপটির ক্ষেত্রমান প্রায় 8.18 বর্গ কিমির কাছাকাছি।মুড়িগঙ্গা নদী তীব্র খরস্রোতার কারণে দ্বীপটির উত্তর-পূর্ব দিকে ক্ষয়কার্য বেশি । সঞ্চয় অপেক্ষা ক্ষয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ায় দ্বীপটি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে। ঢেউ, প্লাবন এবং সাইক্লোনের দাপটে এই দ্বীপের খাসিমারা, লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রাম জলে ডুবে গেছে।খাসিমারা নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের ছাত্ররা পাশের SSKM সেন্টারের ঘরগুলোকে ব্যবহার করে নিত্যদিনের পঠনপাঠন চালায়। হাটখোলা, মন্দিরতলা, চুনপুরী ইত্যাদি গ্রামগুলিরও না থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এভাবে যদি ক্ষয়ের প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তাহলে আগামী ৩০ বছরে দ্বীপটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। ভূতত্ত্ববিদদের মতে হিমালয় পর্বতাংশ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে সাগরের জলে ত্বরান্বিত পলি, বালি, সামুদ্রিক লবণ এবং কাদামাটির ধারা দিয়ে সুন্দরবনের এই সমস্ত দ্বীপগুলির সৃষ্টি। পলিযুক্ত দোআঁশ মাটি এই দ্বীপের চাষযোগ্য ভূমি। জীবনের সন্ধানে যখন মানুষ এসেছে, তার অস্তিত্বের নির্মাণে প্রকৃতির সমারোহের মধ্যে তখনই দ্বীপকে বেষ্টিত করে দিয়েছে বাঁধ। ফলে এর অভ্যন্তরে জল নিকাশি ব্যবস্থায় বিশেষ পরিকল্পনার অভাবে বৃষ্টির ধারা, প্লাবন এবং সাইক্লোনের দাপটে বছরের বেশিরভাগ সময় দ্বীপের নিম্ন ভূমিগুলি থেকেছে জলের তলায়। আবার নদীর জোয়ারভাটার কারণে কোন কোন স্থানের মাটি আধাশক্ত হওয়ার কারণে তেমন সুদৃঢ় নয়; মাটির বুনটের ক্ষেত্রে বালিযুক্ত দোআঁশ, পলিযুক্ত দোআঁশ অথবা কাদা মিশ্রিত দোআঁশ প্রকৃতির হওয়ার ফলে, মাটির দানার আকার ও বিস্তৃতিতে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। । যার pH মানের ব্যাপ্তী ৫.৩ থেকে ৮.০। সোডিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মাত্রা প্রতি ১০০ গ্রাম শুষ্ক মাটিতে ৫.৭ থেকে ২৯.৮ meq এবং পটাসিয়ামের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো মাটিতে ০.৩ থেকে ১.৩ meq। এখানকার শুকনা মাটিতে জৈব উপাদানের মাত্রা শতকরা ৪ থেকে ১০ ভাগ। জুন থেকে অক্টোবর মাসগুলিতে বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা সবচেয়ে বেশি এবং ফেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে কম। অধিকাংশ বৃষ্টিপাত হয় বর্ষা মরসুমে, অর্থাৎ মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। মধ্য-জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় কখনও কখনও ভারী বৃষ্টিপাত হয়। অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ২০২১ সালের মে মাসের শেষ দিকে বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী যে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটি বেশি ছিল। ১৯৫১ সালে এর ক্ষেত্রমান ছিল ৩৮.২৩ বর্গ কিমি, যা ২০২১ সালে ৪.১৮ বর্গ কিমিতে এসে ঠেকেছে। ফলে ৩০-৩৫ টি পরিবার সাগরদ্বীপে চলে গেছেন বা কেউ কাকদ্বীপ ও রামগঙ্গায়, সরকারের সহায়তায় বসবাসের জমি ও বাড়ি পেয়েছে অনেকে ।
এই দ্বীপের অন্তর্গত প্রধান গ্রামগুলি হল বৈঘ্নবপাড়া, বাঘপাড়া, রায়পাড়া, মন্দিরতলা ও চুনপুরি। বর্তমান সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী ৩৫০০ ভোটার ও পাঁচটি অঞ্চল নিয়ে ঘোড়ামারা পঞ্চায়েত গঠিত। এই অঞ্চলে চারটি প্রাইমারি স্কুল ও ঘোড়ামারা মিলন বিদ্যাপীঠ নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় আছে। ঝড় ও সাম্প্রতিক করোনা আবহে দীর্ঘ লকডাউনের জন্য নিয়মিত স্কুলমুখি ছাত্র – ছাত্রীদের খুব অভাব দেখা দিয়েছে। পরিবারের সঠিক জীবিকা না থাকায় এই বেহাল দশা। তাদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ বা মাছ চাষ দুটোই আজকে হাতছাড়া। যাদের দুএকটি জেলে নৌকা আছে তার দ্বীপের আশেপাশের নদীর চুনোচাঁদা ধরাধরি করে পেট চালায়, নয়তো বেশিরভাগ মানুষ চেন্নাই, কেরালা রাজ্যে দিনমজুরি করে। এমনকি তাদের পরিবারের সবাই মিলে চলে গেছে অভাবে তাড়নায় । স্কুলে প্রতিনিয়ত আসা মেধাবী ছাত্রও আজ জীবন যুদ্ধে, করোনা আবহে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমান ঘোড়ামারায় ভাঁটার সময় নদীর নাব্যতা অত্যাধিক কমে যাওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট জেঠিঘাট গড়া সম্ভব হয়নি। দ্বীপের যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম পাশের দ্বীপ গঙ্গাসাগরকে কেন্দ্র করে , তাই এখানকার মানুষজনকে নদী পারাপারের ক্ষেত্রে বেশ বেগ পেতে হয় সরাসরিভাবে কোনো ফেরি পরিষেবা না থাকায়।
প্রকৃতির সাথে মানুষের যে চিরন্তন নিবিড় বন্ধন তা দ্বীপের সবটাই জুড়ে আছে। জীবনে নিত্য দারিদ্র্যের মধ্যে আছে আজন্মের ভালোলাগার ভালোবাসার মানুষ, গাছপালা পশু-পাখি,জল-হাওয়া । আসলে মানুষতো তার জন্মভিটেকে চাইলেই ছেড়ে যেতে পারেনা, যেমন পারেনা পিতা মাতা তার সন্তান সন্ততিকে ছেড়ে যেতে। জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা এই সব স্মৃতির পাহাড়কে সরিয়ে অন্যত্র বসত করার প্রয়াস আর্থিক দুর্ভাবনারও বটে। নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষগুলো চাইলেই কি বাসস্থল বদল করতে পারে, সে যাবেই বা কোথায় খাবেন বা কি। সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার আগে তার যেন লড়াইয়ে অন্ত নেই।