সারসংক্ষেপ
জ্ঞান জগতের প্রায় সব ক্ষেত্র নিয়েই রবীন্দ্রনাথ অল্পবিস্তর ভেবেছেন। সেই চিন্তার ফসল লেখনীর কাঠামোয় বাঁধা পড়ে প্রতিনিয়ত আমাদের সমৃদ্ধ করছে। গ্রন্থাগার বিষয়ক দুটো সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের মধ্যে গহীন জ্ঞানের ডাক শোনা যায়। তাঁর রচনার বিপুল ব্যাপ্তির মধ্যে লাইব্রেরির উল্লেখ বারংবার নজর কাড়ে। যুবক বয়সে ‘বালক’ পত্রিকায় ১২৯২ সনের পৌষ সংখ্যায় লিখলেন ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধটি। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত গ্রন্থাগার সম্মেলনের সভাপতির অভিভাষণ হিসেবে লেখেন ‘লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য’। যা আমাদের চিন্তা চেতনাকে আজও বিমোহিত করে রাখে।
ভুবনডাঙার মাটিতে প্রায় আগুন ধরার অবস্থা। দূরে তালগাছগুলো অসহায়ের মতো ঝিমোচ্ছে। কৃষ্ণচূড়ার লালচে ছায়ায় স্বস্তি খুঁজছে তৃষ্ণার্ত বিহঙ্গরা। হাতপাখা, ভিজে মেঝে, ঠাণ্ডা জলেও ক্লান্তি কাটে না পল্লীবাসীর। কাছেই বিশ্বভারতীর স্কুল ঘর। দহনদিনের দুপুরে তারই একটি ছোট্ট ঘরে লম্বা রোগাটে গড়নের এক ব্যক্তি গভীর মনে সংস্কৃত বইয়ের পাতা উলটাচ্ছেন। মাঝে মাঝে পাশে রাখা খাতায় লিখছেন। নজর করে দেখা গেল কক্ষটি বইয়ে ঠাসা। সংস্কৃত, পালি, ফার্সি, হিন্দি, উর্দু, মারাঠী, গুজরাটি, ওড়িয়া, ইংরাজী কি নেই! বাংলা সাহিত্যের অজস্র গ্রন্থে তাক উপচে পড়ছে। ইনি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কোন ছোটবেলায় পিসতুতো দাদা যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। সম্পর্কের সুতো আজও অটুট। বাবা নিবারণচন্দ্রের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। রবীন্দ্রনাথের আনুকূল্যে লেখাপড়া চলে। পরবর্তীতে কালীগ্রাম পরগনার পতিসরে কিছুদিন সুপারিনটেনডেন্টের কাজ করার পর হরিচরণকে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিদ্যাচর্চার আগ্রহ দেখে কবি তাঁকে বাংলা ভাষায় অভিযান লিখতে বলেন। দারিদ্র্যের কারণে হরিচরণ মন দিয়ে কাজ করতে পারছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের চেষ্টায় কাশিমবাজারের মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী অভিধান লেখার জন্য মাসে পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি দিতে রাজি হন। ১৩৩০ সনে সংকলনের কাজ শেষ হয়। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর মতো সমৃদ্ধ সৃষ্টি পাঠকের দরবারে হাজির হতে পারতো না লেখকের হাড়ভাঙা ধারাবাহিক পরিশ্রম এবং রবীন্দ্রনাথের নির্ভরতা ছাড়া। সারস্বত সমাজের নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং প্রন্থাগারের অহঙ্কার অভিধান সৃজনে রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতার দৃষ্টান্ত তাঁর মননের আরেকটি দিককে উন্মোচিত করে।
জ্ঞান জগতের প্রায় সব ক্ষেত্র নিয়েই রবীন্দ্রনাথ অল্পবিস্তর ভেবেছেন। সেই চিন্তার ফসল লেখনীর কাঠামোয় বাঁধা পড়ে প্রতিনিয়ত আমাদের সমৃদ্ধ করছে। গ্রন্থাগার বিষয়ক দুটো সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের মধ্যে গহীন জ্ঞানের ডাক শোনা যায়। তাঁর রচনার বিপুল ব্যাপ্তির মধ্যে লাইব্রেরির উল্লেখ বারংবার নজর কাড়ে। যুবক বয়সে ‘বালক’ পত্রিকায় ১২৯২ সনের পৌষ সংখ্যায় লিখলেন ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধটি। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত গ্রন্থাগার সম্মেলনের সভাপতির অভিভাষণ হিসেবে লেখেন ‘লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য’।
জীবনের প্রভাত বেলাতেই আমাদের অধিকাংশের গ্রন্থাগারের সাথে আলাপ হয়ে যায়। বড়োদের হাত ধরে পৌঁছে যাই পাড়ার ছোট্ট বইয়ের দুনিয়ায়। পরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর পরতে পরতে পরিচিত হই নানা ধরনের গ্রন্থালয়ের সাথে। রবীন্দ্রনাথও দেশ বিদেশের অসংখ্য গ্রন্থাগারে গিয়েছেন। ‘জীবনস্মৃতি’তে বিলেতে ইউনিভার্সিটি কলেজ লাইব্রেরির সরস বর্ণনা আছে। গ্রন্থাগারের স্বরূপ উন্মোচন করে কবি লিখেছেন ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া ওঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানব হৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।’ (লাইব্রেরি)
মানুষের চিন্তা চেতনার বিকাশের জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। মূলত বই নিয়েই লাইব্রেরি । বইয়ের শক্তি সম্পর্কে পাঠককে সচেতন করতে গিয়ে কবি লিখেছেন ‘বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে! কে জানিত সঙ্গীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে? কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে, অতলস্পর্শ কাল-সমুদ্রের উপর কেবল এক একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে!’ (লাইব্রেরি) বইই পারে আমাদের জানা শোনার আকাশকে আরো উন্মুক্ত করে দিতে। জন্মদিনে’র ১০ নং কবিতায় আছে সেই সত্যের প্রকাশ-
“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি!
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।’
১৩৩২ সনে গ্রস্থাগার আন্দোলনের নেতা সুশীলকুমার ঘোষ শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে লাইব্রেরি নিয়ে আলোচনা করেন। ‘গ্রন্থাগার’ পত্রিকার একাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যায় সেই সাক্ষাৎকারের লিখিত পরিচয় আছে। কবি সুশীলকুমারকে বলেছেন ‘গ্রন্থাগার আমার নিকট অতি মূল্যবান বস্তু, সমাজের এক অপরিহার্য অবয়ব। গ্রন্থালয় ভবনে সঞ্চিত থাকে অমূল্য সম্পদ- পুরাবৃত্তের কাহিনী, প্রাচীন ঋষি ও সুবিজ্ঞ মনীষীদের চিন্তাধারা যাহা শাশ্বতকাল ধরিয়া আমাদের প্রাণে বল ও জ্ঞান সঞ্চার করিবে। বিগত যুগের বিবিধ জ্ঞান ও রত্ন আমাদের আহরণ করিতে সুযোগ দেয় এই গ্রন্থালয়। এইজন্য আমার নিকট ইহা পবিত্র ভূমি। দেশ বিদেশকে ইহা নিকটে টানিয়া আনে। সুদূর প্রতীচ্য দেশের বিভিন্ন বার্তা এমন কি প্রাচ্য কাহিনীও যাহা কালের কবলে বিলুপ্ত হইয়া যাইতে পারে- তৎসমুদয় ইহার মধ্যে সযত্নে সংরক্ষিত। সেইজন্য লাইব্রেরি আমার নিকট প্রিয় বস্তু। ‘
তবে বই কেনার ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। গ্রন্থাগারের ধরনের উপর নির্ভর করে যে সেখানে কি ধরনের বই রাখলে পাঠকদের বেশি কাজে লাগবে। কবি আক্ষেপ করেছেন ‘অধিকাংশ লাইব্রেরিই সংগ্রহবাতিকগ্রস্ত। তার বারো আনা বই প্রায়ই ব্যবহারে লাগে না, ব্যবহারযোগ্য অন্য চার আনা বইকে এই অতিস্ফীত গ্রন্থপুঞ্জ কোণঠাসা করে রাখে।’ (লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য)। সমরূপ সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। বই ব্যবহারের জন্য। সেটা ঘর সাজাবার উপকরণ নয়। ‘ক্ষণিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘যথাস্থান” কবিতাতেও তাঁর উচ্চারণ শুনি-
পাষাণ-গাঁথা প্রাসাদ পরে
আছেন ভাগ্যবন্ত,
মেহগিনির মঞ্চ জুড়ি
পঞ্চ হাজার গ্রন্থ-
সোনার জলে দাগ পড়ে না,
খোলে না কেউ পাতা,
অ-স্বাদিত মধু যেমন
যূথী অনাঘ্রাতা।’
লাইব্রেরি আকারে বড়ো করলাম, অথচ পাঠকের চাহিদা পূরণ হলো না। অব্যবহৃত পুস্তকে গ্রন্থালয় ভারাক্রান্ত করার চেয়ে পড়ুয়ার উপযোগী উপকরণে মালা গাঁথলে সুগন্ধ ছড়াবে বেশি। পক্ষপাতের পরিবর্তে বৈচিত্র্যের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে হবে সংগ্রহকে। তবেই অধ্যয়নশীলের অভিলাষ পূরণ হবে। ‘লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব হৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যেদিকে ইচ্ছা ধাবমান হও; কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে।'(লাইব্রেরি)
রবীন্দ্রনাথ জানতেন প্রকৃত শিক্ষা পেতে হলে লাইব্রেরি- ভরসাভূমি। নিজের ইচ্ছেমতো পড়লেই অবগতির বেগ বাড়ে। আর সেই বেগ বৃদ্ধিতে লাইব্রেরিরও একটা দায় আছে- “সে হচ্ছে তার সম্পদের দায়। যেহেতু তার বই আছে সেইহেতু সেই বইগুলি পড়িয়ে দিতে পারলেই তবে সে ধন্য হয়। সে অক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে না। সক্রিয়ভাবে যেন সে ডাক দিতে পারে।” (লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য)। পাঠক তৈরিতে গ্রন্থালয়েরও অভিভাবকত্বের আসন অর্জন অবশ্য পালনীয়।
“লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য’ রচনাটিতে লাইব্রেরির কার্যগত দিকের সারবত্তার বিকিরণ ঘটেছে। গ্রন্থাগারিককে বিবেচনা করে বই নির্বাচন করতে হয়। গ্রন্থাগারে বই আসার পর সেটি পাঠকের হাতে তুলে দেবার আগে কতকগুলি টেকনিক্যাল কাজ সেরে ফেললে সকলেরই সুবিধা। যেমন পরিগ্রহণ খাতার বইয়ের পরিচয় লিপিবদ্ধ করা, বর্গীকরণ, সূচীকরণ, নির্ঘন্ট প্রস্তুত করা। তাহলে বিদ্যার্থীকে বইটির কাছে যেতে আর দুর্গম পথ পেরতে হবে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘মনে করো কোনো লাইব্রেরিতে ভালো ভালো মাসিকপত্র আসে, কতকগুলি দেশের, কতকগুলি বিদেশের। যদি লাইব্রেরির যাচাই-বিভাগের কোনো ব্যক্তি তাদের থেকে বিশেষ পাঠ্য প্রবন্ধগুলিকে শ্রেণীবিভক্তভাবে নির্দিষ্ট করে একটা তালিকা পাঠগৃহের দ্বারের কাছে ঝুলিয়ে রাখেন তা হলে সেগুলি পাঠের সম্ভাবনা নিশ্চিত বাড়ে। নইলে এই সকল পত্রিকা বারো আনা অপঠিতভাবে স্তূপাকার জমে উঠে লাইব্রেরির স্থান ক্ষয় ও ভারবৃদ্ধি করে। নুতন বই এলে খুব অল্প লাইব্রেরিয়ান তার বিবরণ নিজে জেনে পাঠকদের জানিয়ে দেবার উপায় করে দেন। যে কোনো বিষয়ে ভালো বই আসামাত্র তার ঘোষণা হওয়া চাই।’ গ্রন্থাগারিককে একটা পাঠকমণ্ডলী গড়ে তুলতে হবে। কি ধরনের বই বাজারে আসছে তার অনুসন্ধানও করতে হবে। গ্রন্থাগার কর্মীদের সচেতন করতে এই প্রবন্ধের বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিনি শিক্ষার বিকাশ ঘটানোর জন্য ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কথাও বলেন।বীরভূমস্থ শ্রীনিকেতনে এই ব্যবস্থা চালুও করেন। গ্রামবাসীকে জ্ঞানের আলোতে নিয়ে আসতে কবির চেষ্টার অন্ত ছিলো না।
বোধের বিকাশ ঘটাতে বইয়ের মতো সাথী কেউ নেই। রকমারি পুস্তক পাঠের সুযোগ করে দেয় পাঠাগার। এতে বই কেনার খরচ বাঁচে সময়ের সাশ্রয় হয়। তবে তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পদ যাতে সুরক্ষিত থাকে সে ব্যাপারে সচেতন করেছেন কবি। ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘কীটের বিচার’ কবিতায় রসিকতা করেছেন-
‘মহাভারতের মধ্যে ঢুকেছেন কীট,
কেটে কুটে ফুঁড়েছেন এপিঠ-ওপিঠ।
পণ্ডিত খুলিয়া দেখি হস্ত হানে শিরে;
বলে, ওরে কীট, তুই একী করিলেরে!’
কীটের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে আমাদের ঐতিহ্যকে। তবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি আরশোলা, উইপোকার থেকে গ্রন্থাগারের বেশি ক্ষতি করে মানুষ। রবীন্দ্রনাথের ‘পারস্য’ প্রবন্ধে সেই আপ্তবচন কথিত হয়েছে “এই পার্সিপোলিসে ছিলো দরিয়ুসের গ্রন্থাগার। বহু সহস্র চর্মপত্রে রূপালী সোনালি অক্ষরে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা লিপিকৃত হয়ে এইখানে রক্ষিত ছিলো। যিনি এটাকে ভস্মসাৎ করেছিলেন তাঁর ধর্ম এর কাছে বর্বরতা। আলেকজান্ডার আজ জগতে এমন কিছুই রেখে যাননি যা পার্সিপোলিসের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তুলনীয় হতে পারে।”
গ্রন্থাগার আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় যোগদান করেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের থেকে মুক্তির আশায় ছাত্র যুবক সাধারণ মানুষ ক্লাব, ব্যায়ামাগার, গ্রন্থাগারগুলিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হচ্ছিল। ফলে শাসকের কুনজরে পড়ে সাধারণ পাঠাগার। মাঝে মাঝেই সেখানে পুলিসী হামলা চলত। ছড়িয়ে থাকা গ্রন্থাগারগুলি অনুভব করছিলো সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাওয়ার। কলকাতার অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউট হলে ১৯২৫ সালের ২০ ডিসেম্বর ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক জে এ চ্যাপম্যানের সভাপতিত্বে এক সম্মেলন হয়। রবীন্দ্রনাথের বাণী পাঠের পর অল বেঙ্গল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয় উক্ত সমাবেশে। সভাপতি হন রবীন্দ্রনাথ, সম্পাদক সুশীলকুমার ঘোষ। ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির নব নামকরণ হয় বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ। পশ্চিমবঙ্গে গ্রন্থাগার আন্দোলনের মঞ্চ তৈরি হলো। ১৯২৮ সালের ২৬ এবং ২৭ ডিসেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে নিখিল ভারত গ্রন্থাগার সম্মেলনের ষষ্ঠ বার্ষিক সম্মেলন হয়। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন রবীন্দ্রনাথ। তবে অসুস্থতার কারণে তিনি সেদিন যেতে পারেননি। তাঁর লিখিত বক্তৃতা পড়ে শোনান হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কলকাতার চৈতন্য লাইব্রেরির সাথে কবির গভীর যোগাযোগ ছিলো। ১৮৯১ সালে সেখানের সহ সভাপতি হন। চৈতন্য লাইব্রেরির বিভিন্ন সভাতে তিনি প্রায় ৮টা প্রবন্ধ পাঠ করেন। যার মধ্যে অন্যতম ইওরোপ যাত্রীর ডায়েরি, ইংরাজ ও ভারতবাসীর সম্বন্ধ, বঙ্কিমচন্দ্র, মেয়েলি ছড়া, স্বদেশী সমাজ, পথ ও পাথেয়, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা। ১৯৩৩ সালে বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরির সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই উপলক্ষে দার্জিলিঙ থেকে বাণী পাঠান ‘তোমাদের বাগবাজারের গ্রন্থ পাঠালয়ের পঞ্চাশ দ্বার্ষিকী উপলক্ষে আমার শুভকামনা নিবেদন করিতেছি। বর্ষে বর্ষে পাঠ্য ভাণ্ডারের সমৃদ্ধি পূর্ণতর হইয়া পাঠকদের আদরণীয় হউক এই আমার আশীর্বাদ।’ শুভেচ্ছাপত্রটি গ্রন্থাগারে বাঁধানো আছে। পাঠাগারের উন্নয়নে তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। যেখানেই গিয়েছেন, গ্রন্থাগার নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। “রাশিয়ার চিঠি’র নবম পত্রে লিখেছেন ‘এদের বিপ্লবের সময় উপরতলার অনেক জিনিস নিচে তলিয়ে গেছে একথা সত্য, কিন্তু টিঁকে রয়েছে এবং ভরে উঠেছে মিউজিয়াম, থিয়েটার, লাইব্রেরি, সঙ্গীতশালা। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের প্রায় ১৩ বছর পর সোভিয়েতে যান কবি। তখন সেখানে সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের কাজ জোরকদমে চলছে। কৃষি, শিক্ষা, শিল্পে অভাবনীয় উন্নতি হচ্ছে। তা দেখে কবি অত্যন্ত তৃপ্তবোধ করেন। ‘শিক্ষা ব্যাপারকে এরা নানা প্রণালী দিয়ে, সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজীবন চেষ্টা করেছেন শিক্ষার আলো সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার। তাই জনশিক্ষার বাহক গ্রন্থগারের বিকাশে প্রাণমন ঢেলে দিয়েছিলেন শত ব্যস্ততার মাঝেও।
তথ্যসূত্র:
১. বিমলকুমার দত্ত/রবীন্দ্রসাহিত্যে গ্রন্থাগার
২. রামকৃষ্ণ সাহা, সম্পাদিত/রবীন্দ্রনাথ ও গ্রন্থাগার