সমাজ বাস্তবতার আলোকে মালদা জেলার মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকগান :ড. মহ. মহিদুর রহমান

লোকগান লোক জীবন চর্চার ফসল। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনচর্চা, সংস্কৃতি, মন ও মনন নিয়ত পরিবর্তিত। লোকগান সেই বিবর্তিত জনজীবনের বাস্তবতাকে মূর্ত করে তোলে।   একুশ শতকে যান্ত্রিক সভ্যতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে বিনোদনের বিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সহজাত সংস্কৃতির প্রাণময় আবেদনের পরিবর্তে কৃত্রিমতার স্বাদ অনুভব করি ক্রমশই। গীদ বা গীতধ্বনি মানুষের আপন মনের সুরেলা প্রকাশ। মানবিক আবেদনে, সরস ভাষায় যে গীদগুলি গ্রামে-গঞ্জে প্রতিনিয়ত প্রবহমান ছিল পাশ্চাত্য প্রভাবে তাতে লেগেছে যান্ত্রিকতার রঙিনস্পর্শ। কিন্তু তবুও আজও সমাজে প্রচলিত লোকগান। সুস্থ স্বাভাবিক সেই প্রাণময় গীতে আজও মেতে ওঠে মানুষ। ফিরে পান জীবনের বেঁচে থাকার রসদ। মালদা জেলার ঐতিহ্যবাহী এই গীতগুলি অন্যান্য অঞ্চলের মতো লুপ্তপ্রায় হলেও ক্ষেত্রসমীক্ষায় বহু  দুষ্প্রাপ্য গীত প্রাপ্ত হয়েছে- যেগুলি বহুদিন ধরে মুসলিম জনজাতির জীবনচর্যার এক অমূল্য সম্পদ। 

লোকগান সংগ্রহে মালদা জেলার মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনচর্চা ও জীবনবোধকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে আলোচনা করলে দেখা যায়, এ শুধুমাত্র মুসলিম সমাজের নয়, মানুষের জীবনবোধের বিকাশ। নারীমহলের গীতের মধ্যে আছে বিবাহের গীত, ঢেঁকি, যাঁতা ও কাঁথা সেলাইয়ের গান, তেমনি পুরুষ সমাজের মধ্যে প্রচলিত মহরমের গান, পয়গম্বরের জন্মোৎসব বিষয়ক গান ইত্যাদি। এই লোকগানগুলির মধ্যে সংশ্লিষ্ট সমাজের বাস্তবতাকে সমকালীন ও বর্তমান সমাজ প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা যেতে পারে।  

ভৌগোলিকগত বিচারে মালদা জেলা মূলত ৩ (তিনটি) টি অংশে বিভক্ত- বরিন্দ, টাল, ও দিয়াড়া। মহানন্দা নদীর পূর্বদিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ‘বরিন্দ’ নামে পরিচিত। ‘বরিন্দ’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ ভূমি। অন্যদিকে মহানন্দার পশ্চিম পূর্বাঞ্চলে প্রবাহিত কালিন্দ্রি নদীর উত্তরভাগ ‘টাল’ নামে পরিচিত। আর কালিন্দ্রির দক্ষিণভাগ ‘দিয়াড়া’ নামে পরিচিত। 

মালদা জেলায় বহু ভাষা–ভাষী মানুষের  বসবাস। তাদের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবন-যাত্রা, উৎসব- সংস্কৃতি, বিনোদন যাপন আজও ঐতিহ্যময়। যান্ত্রিক সভ্যতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আজ অনেকটাই লুপ্তপ্রায়। ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের বিবাহ ও অন্যান্য উৎসবে গাওয়া গীতগুলি প্রাণময় তথা মর্মস্পর্শী। বিষয়ের দিক থেকেও সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের জীবনের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা-বেদনার দীর্ঘশ্বাস, সুতীব্র ক্ষোভ, মর্মবেদনা, রঙ্গ-ব্যঙ্গ ও কৌতুকের মধ্য দিয়ে জীবনের মূল সত্য প্রকাশিত। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে গীত বা লোকসমাজে প্রচলিত গানগুলি আজও সমাজের সুগভীর সত্যের বাহক। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের দৌরাত্ম্য, সামাজিক পীড়ন, শাসন–শোষণে কীভাবে অবহেলিত নারীসমাজ পৌরুষের যূপকাষ্ঠে নিজেদের বলি দিতে বাধ্য হয়- তারই নানান জীবন্ত চিত্র গানগুলির মধ্যে নানা ভাবে উদ্ভাসিত। বিশেষত এই জেলার মুসলিম সম্প্রদায়ের গীতগুলিতে সমাজের সেই জীবন্ত রূপ আজও বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুসলিম লোকগানের মধ্যে আছে বিবাহের গান, মহরমের গান, পয়গম্বরের জন্মোৎসব বিষয়ক গান ইত্যাদি।  

শেরশাবাদিয়া সম্প্রদায়ের বিবাহের গীত (গীদ) 

শেরশাবাদিয়া জনগোষ্ঠী মূলত আফগান দেশীয় পাঠান মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ ধারা মাত্র। এদের পূর্বপুরুষ সুদূর আফগান শাখা জনজাতি। অনেকের মতে, ‘সেরসাবাদ’ পরগণায় বসবাসকারী ব্যক্তিরাই শেরশাবাদিয়া নামে পরিচিত। 

         শেরশাবাদিয়া ভাষায় ‘গীদ’ কথার অর্থ আনন্দ উৎসব বা হৈ-হুল্লোড়। ‘গীদ’ শব্দটি শেরশাবাদিয়া ভাষার লোকসংস্কৃতির নিজস্ব শব্দ। এই সম্প্রদায়ের একটি বিয়ের গীদ- 

‘আরশ মাগী গীদ্যার ক্যানে করে রে

ভকনা ভাতার লিয়্যা ।

আরস মাগীকে দারিদরে পার করে’।

বাঙ্গাল সম্প্রদায়ের  বিবাহের গীত-

নস্য সেখ মুসলমানরা ছিল মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাজবংশী সম্প্রদায়ভুক্ত। উচ্চবিত্ত হিন্দুদের শাসন ও শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত হেতু তাদের জাতি নষ্ট হওয়াই ‘নষ্ট’ কথাটির অপভ্রংশে ‘নস্য’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এছাড়া এরা ‘বঙ্গালভূম’ এর অধিবাসী হওয়াই এই রাজবংশীরা ‘বাঙ্গাল’ বা ‘বাঙাল’ নামে পরিচিত।

এই সম্প্রদায়ে বিবাহের দিন বর বা কনেকে হলুদ লাগানো হয়। এই সম্প্রদায়ের একটি বিয়ের গীত-  

সোনার কটরা তেল রে

হলদি রূপার কটরা কাসাইরে

বারে বারে মানা কোরনু

ওরে তেল দিয়ো সরিষার তেল।

                          খোট্টা সম্প্রদায়ের বিয়ের গীত-

মালদা জেলার রতুয়া থানা সংলগ্ন এক বৃহত্তর ‘দিয়াড়া’ অঞ্চল জুড়ে খোট্টা ভাষীদের বসবাস। ভাষা-ভাষী। এরা মূলত ‘দ্বারভাঙ্গা’ এলাকা থেকে রাজা মানসিংহের আমলে তাঁর সৈন্য হিসেবে আসে। রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক কারণে মালদা জেলার ‘দিয়াড়া’ এলাকায় বসবাস শুরু করে। তাদের বিবাহের গীতগুলি আবেদনের দিক থেকে অন্যান্য ভাষীর মতো হলেও প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা শৈলীর দিক থেকে অনেকটাই অভিনব। একটি গান প্রসঙ্গত উল্লেখ্য- 

তেরে উপাটান মাখানেকো বেলা রে ,

বোলাদো উনাকি বাহিন কো

মেরে ছোটে মাহালকি রাণী কো। 

মহরমের গানঃ আরবি মহরম মাসের ১০ই মহরম মুসলিম সম্প্রদায় হাসান হোসেনের স্মৃতি রক্ষার্থে কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে লাঠিখেলার সঙ্গে সঙ্গে তাজিয়া বানায়, অনেকে মাটির ঘোড়া তৈরি করে। তবে মালদা জেলায় মহরমের উৎসবে ঝাড়নি গানের বহু প্রচলন আছে। এই ঝাড়নি গানের সঙ্গে শোক প্রকাশের মাধ্যমকে পরবর্তীতে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ করেছে। 

মহরম মাসে কারবালার যুদ্ধ স্মৃতিকে কল্পনা করে গাওয়া হয় মরসিয়া গান। এই ‘মরসিয়া’ শব্দের অর্থ আসলে শোকগীতি। এর বিষয়বস্তু মৃত ব্যক্তির শৌর্য-বীর্যের এবং প্রতাপপত্তির গুণাবলির প্রকাশ। এই মরসিয়া গানকে অবস্থান এবং পরিস্থিতি পরিবেশ লক্ষ করে অনেকেই কতগুলি ভাগে ভাগ করেছেন-

ক) মাতম

খ) জারি

গ) গম

ঘ) ঝাড়নি।

  যেমন একটি জারি গানের সামান্য কয়েকটি পঙক্তি উল্লেখ করা হল-

কান্দেন সখিনা বিবি বসি জারে জার।

জারে জারে কান্দে বসি কোলে লিয়া মাথা।

পয়গম্বরের জন্মোৎসব বিষয়ক গানঃ ‘পয়গম্বর’ অর্থাৎ শেষ নবী হজরত মহম্মদ (সাঃ) এর জন্মদিবস উপলক্ষ করেই মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষত বাঙ্গাল সম্প্রদায়ের মানুষেরাই এই নবীজির জন্মোৎসব বিষয়ক গান গেয়ে থাকে। তবে এই লোকগানগুলি শাস্ত্রীয় মতে নয়, লোকমানসের নিজস্ব সৃষ্টিতে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। 

ঢেঁকি, যাঁতা, কাঁথা সেলাইয়ের গান।

ঢেঁকি, যাঁতা, কাঁথা সেলাইয়ের গানগুলি মূলত শ্রমপরিহরণমূলক গীত হিসেবেই বিবেচিত। গ্রাম-গঞ্জে এই গানগুলি প্রায় লুপ্ততার পথে। ক্ষেত্রসমীক্ষায় প্রাপ্ত কয়েকটি গীত বিশ্লেষণে দেখা যায়, সমস্বরে ধান ভানার সময় তিন-চার জন মহিলা ঢেঁকির গোড়ায় পা দিয়ে চাপ দিয়ে ধান ভানে (ভাঙে)। প্রসঙ্গত একটি ঢেঁকিতে ধান ভানার গীত-

ও ধান ভানো রে ভানো রে মোর গীদ শুনি

বিরিন্দ্যা বনে ধান ষোল্ল সাগোর পাড়ি।

ও ধান ভানো রে ভানো রে মোর লি গীদ শুনি

ঢেকিট্যা বলে রে ভাই, আমিন্যাদের  হাতি

অষ্ট অঙ্গ ছ্যাইড়্যা দিয়্যা ন্যাজে মারে লাথি।

 একটি ‘যাঁতা পিষা’ গীতে আছে গ্রাম্য নারী-পুরুষের প্রণয়লীলা। নানান উপমার মধ্য দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ সাংসারিক জীবনে নতুন অতিথির আগমনের আভাস ধ্বনিত হয়েছে-

বড় নেমুর তলে নাজির‍্যা ক্যাঁথা সিঁয়াইছে

আহা ভেস গুলাবি নেমু হামার ডালে ধইর‍্যাছে।

ক্যাঁথা সিঁয়্যা দ্যাখে হাসিবুর গাছে চইর‍্যাছে

গাছে চোড়হ্যা হাসিবুর নেমু ফেল্যাছে,

সে না নেমু খাইয়্যা নাজির‍্যার প্যাট হয়্যাছে।

কাঁথা সেলাই আজও বহু গ্রাম-গঞ্জে প্রচলিত। তবে আজ খুবই কম চোখে পড়ে। গ্রামের প্রায় অশিক্ষিত নারীরাই এই কাঁথা সেলাইয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই সেলাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে গীত গেয়ে ওঠে তারা। এটিও শ্রমপরিহরণমূলক গীত। দীর্ঘক্ষণ একটানা কাঁথা সেলাইয়ে কোমর পিঠে টান ধরে। চোখের জ্যোতি ক্ষয় হয়। তাই পরিশ্রমকে লঘু করতেই ঝুঁকে ঝুঁকে গুন গুন করে গীত ধরে। প্রসঙ্গত একটি গীতে তারই রূপচিত্র ধরা পড়েছে- 

বাঁশের পাতা লড়ে চড়ে

মা কইহ্যা মনে পড়ে।

বেটি হায়রে বেটি কান্দিস ন্যা।

মালদা জেলার মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকগানগুলি ক্ষেত্রসমীক্ষায় উদ্ধারে দেখা যায়, গ্রামগঞ্জে বৈদ্যুতিন যন্ত্রের অত্যধিক প্রসারের ফলে, ডিজিটালের দাপটে অমূল্য গ্রামীণ লোকগানগুলি আজ প্রায়শই লুপ্ত হতে চলেছে। মানুষের সুখ-দুঃখ বিজড়িত প্রাণসম্পদগুলি হয়তো কালের গর্ভে মিলিয়ে যেতে পারে একদিন। আর এই লোকগানগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাদের জীবনের বহুমুখী জীবনের সন্ধান ।

Dr.Md Mohidur Rahaman, Assistant Professor, Department of Bengali, Chanchal College, Malda, India